যুগল

যুগল

“আহহা, দেরি হয়ে গেছে,” বিড়বিড়িয়ে বললো যুবক। “আমাকে উঠতে হবে এখন”। তার আচরণেই স্পষ্ট যে কোনমতে এখান থেকে উঠে যেতে পারলেই বাঁচে।

“তাই?!” সামনে বসে থাকা যুবতী বললো। দৃষ্টিতে অনিশ্চয়তা খেলা করছে তার। এখন অবধি যুবক অবশ্য বলেনি যে তাদের মধ্যে সবকিছু পুরোপুরি চুকেবুকে গেছে। কিন্তু তিন বছরের প্রেমিকাকে আজ সে ডেকে পাঠিয়েছিল কিছু ‘গুরুত্বপূর্ণ কথা’ বলবার জন্যে। আলাপের এক পর্যায়ে হঠাৎই সে জানায় যে চাকরির খাতিরে মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি জমাতে হবে। খুব বেশি সময়ও নেই হাতে। আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ছেড়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্রগামী ফ্লাইট। ততক্ষণে মেয়েটা বুঝে গেছে যে কথাবার্তা কোনদিকে এগোচ্ছে। নিশ্চয়ই ব্রেকআপের কথা বলবে বলেই আজ এখানে নিয়ে এসেছে তার প্রেমিক। অথচ ও কিনা আশায় বুক বেধেছিল যে ‘গুরুত্বপূর্ণ কথা’ বলতে হয়তো বিয়ে সংক্রান্ত কিছু বুঝিয়েছিল সে।

“কি?” শুকনো কন্ঠে বললো যুবক। এখনও তার চোখে চোখ রাখছে না।

“শুধু এটুকুই বলার আছে তোমার?” জিজ্ঞেস করলো ও।

যুবতী জানে যে এভাবে প্রশ্নের সুরে কথা বলাটা পছন্দ করে না তার প্রেমিক। এই মুহূর্তে বেইজমেন্টের একটা ক্যাফেতে বসে আছে ওরা দু’জন। আলোর উৎস বলতে সিলিং থেকে ঝুলন্ত ছ’টা ল্যাম্প এবং প্রবেশপথের কাছে ছোট্ট একটা ঝারবাতি। ভেতরের সবকিছুতেই বয়সের ছাপ। পুরনো দিনের ছবির মতন কালচে বাদামী আভা চারদিকে। ঘড়ি ছাড়া ভেতরে সময় বোঝার কোন উপায় নেই।

ক্যাফের একপাশে তিনটা বিশাল অ্যান্টিক দেয়ালঘড়ি ঝোলানো। প্রত্যেকটা ঘড়ি আবার ভিন্ন ভিন্ন সময় দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা কি ইচ্ছেকৃত? নাকি ঘড়িগুলোয় সমস্যা আছে? প্রথমবার আগত খদ্দেরদের এই ধাঁধার জবাব পেতেই সময় লেগে যায় অনেকক্ষণ। অগত্যা নিজেদের হাতঘড়ির ওপরেই ভরসা করতে হয় তাদের। লোকটাও সেই পথেই হাঁটলো। ঘড়ির ডায়ালে চোখ দিয়ে আরেক হাতের আঙুলগুলো নিয়ে এলো ডান ভ্রু’র উপরে। নিচের ঠোঁটটা কাঁপছে মৃদু মৃদু।

অন্য সময় দৃশ্যটা যুবতীর মনে মায়ার উদ্রেক ঘটালেও আজ বিরক্তিকর ঠেকছে সবকিছু। “তোমার চেহারা দেখে কিন্তু সবাই ভাববে আমি বুঝি তোমাকে যন্ত্রনা দিচ্ছি,” বললো সে।

“আরে না, আমি অমন কিছু ভাবছি না,” লজ্জিত স্বরে বললো লোকটা।

“ভাবছো!”

আবারো আগের ভঙ্গিতে কথাটা এড়িয়ে গেল যুবতীর প্রেমিক। দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। তার এরকম উদাসীন ভাবভঙ্গি বেচারির রাগে যেন ঘি ঢালছে। “তুমি তাহলে চাইছো আমার মুখ থেকে কথাটা শুনতে?”

কফির কাপে হাত রাখলো সে। একদম ঠা-া হয়ে গেছে। গরম কফিতে চুমুক দেয়ার সুযোগ হারিয়ে মেজাজের আরো অবনতি হলো যুবতীর।

আরো একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে মনে ফ্লাইট ছেড়ে যেতে কতক্ষণ সময় বাকি, সেই হিসেব কষে নিল যুবক। ঠিক সময়মত পৌঁছাতে চাইলে খুব দ্রুত ক্যাফে ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে তাকে। নিজেকে সামলানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে আবারো ডান হাতের আঙুলগুলো কপালের কাছে নিয়ে এলো সে। এটা তার একটা মুদ্রাদোষ।

প্রেমিকের বারবার সময় দেখা বিরক্তির পরিমাণ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে যুবতীর। প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত শব্দ করে কাপটা নামিয়ে রাখলো সে পিরিচের উপরে।

চমকে গেল যুবক। কিছুক্ষণ আগেও ডান ভ্রু’র উপরে থাকা আঙুলগুলো এখন শোভা পাচ্ছে চুলের মাঝে। বিভ্রান্ত অবস্থায় চুল টানার অভ্যাস তার দীর্ঘদিনের। কিন্তু এরপরেই বদলে গেল চিত্রপট। লম্বা একটা শ্বাস টেনে যুবতীর চোখে চোখ রাখলো সে। খানিক আগের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠেছে পুরোপুরি। চেহারা একদম শান্ত।

প্রেমিকের মুখভঙ্গির আকস্মিক এই পরিবর্তনে রীতিমতো হকচকিয়ে গেল যুবতী। চোখ নামিয়ে নিজের কোলের উপরে দৃষ্টি স্থাপন করলো।

যুবক অবশ্য পরবর্তী কথাগুলো বলার জন্যে আর অপেক্ষা করলো না। তাড়া আছে তার। “আসলে, দেখো…”

এখন আর বিড়বিড় করছে না সে। নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে।

“কিছু বলতে হবে না। তুমি চলে যাও,” যুবকের কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠলো যুবতী। চোখজোড়া এখনও নামিয়ে রেখেছে সে।

কে বলবে যে এতক্ষণ সে-ই কিনা প্রেমিকের মুখ থেকে কিছু শোনার জন্যে উদগ্রীব হয়ে ছিল? স্থাণুর মত বসে আছে যুবক। দেখে মনে হবে যেন সময় স্থির হয়ে গেছে।

“তোমার তো এখন যেতে হবে, তাই না?” বাচ্চাদের মত অসহিষ্ণু কন্ঠে বললো যুবতী।

জবাবে বিস্মিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো যুবক, যেন বুঝতে পারছে না প্রেমিকা কি বলছে।

যুবতী জানে তার কথাগুলো কতটা ঠুনকো শোনাচ্ছে। সেজন্যেই বোধহয় অন্যদিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে ভীষণ। চেয়ার ছেড়ে উঠে কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো ওয়েট্রেসের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লো যুবক।

“এক্সকিউজ মি, আমাদের বিলটা দিয়ে দিতে চাইছি এখনই,” ক্ষীণকন্ঠে বললো সে। এরপর টেবিলে রাখা বিলের কাগজটা উঠিয়ে নিতে গিয়ে দেখলো যুবতী সেটা হাত দিয়ে চেপে রেখেছে।

“আমি আরো কিছুক্ষণ থাকবো…যাবার সময় আমিই বিল দিয়ে দিব,” কিন্তু তাকে কথা শেষ করতে দিল না যুবক। বিলের কাগজটা টান দিয়ে ছুটিয়ে নিল সহজেই। হাঁটা দিল ক্যাশ রেজিস্টারের দিকে।

“হ্যাঁ, একসাথে বিল হবে”।

“বললাম তো আমি দিয়ে দিব”।

চেয়ার থেকে না উঠেই যুবকের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিল যুবতী।

কিন্তু তার কথা যেন কানেই ঢুকছে না যুবকের। চেয়ার ছেড়ে ওঠার পর এখন অবধি একবারের জন্যে তাকায়নি পর্যন্ত। ওয়ালেট থেকে এক হাজার ইয়েনের একটা নোট বের করলো সে।

“বাকিটা আপনি রেখে দিন,” বিলের কাগজ এবং নোটটা ওয়েট্রেসের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো যুবক। এরপর বিষাদগ্রস্থ চোখে প্রেমিকার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল ক্যাফে থেকে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Chat with Afsar Brothers