অটোমান সাম্রাজ্য ভাগাভাগি

সাহাদত হোসেন খান

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির অংশীদার হওয়ায় বিজয়ী মিত্রপক্ষ অটোমান সাম্রাজ্য ভাগাভাগি করে। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা এ সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করে। একইসঙ্গে অটোমান সালতানাতের বিলুপ্তি ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এ অবিস্মরণীয় রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে এবং ১৯১৮ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ, ফরাসি ও ইতালীয় সৈন্যরা কন্সটান্টিনোপল দখল করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে মিত্রশক্তি কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্য ভাগাভাগির পরিকল্পনা করে। এসব চুক্তি ও সমঝোতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাইকস-পিকোট চুক্তি, বেলফোর ঘোষণা, সেভার্স চুক্তি, লাউসেন চুক্তি এবং হোসেন-ম্যাকমোহন পত্রবিনিময়। মহাযুদ্ধ আসন্ন হয়ে উঠলে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার কাছে অটোমান সাম্রাজ্য নিরাপত্তা দাবি করে এবং অবশেষে জার্মানির সঙ্গে জোট গঠন করে। বিশাল বিশাল ভূখ- এবং জাতি নিয়ে গঠিত অটোমান সাম্রাজ্যকে কয়েকটি নয়া রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হয়। এ সাম্রাজ্য ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শগতভাবে শীর্ষস্থানীয় ইসলামী রাষ্ট্র ছিল। অটোমান সাম্রাজ্য ভাগাভাগি হলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রভাবাধীন একটি মধ্যপ্রাচ্য, আধুনিক আরব বিশ্ব ও তুরস্কের জন্ম হয়। এক শো বছর আগে আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ ভূখ- ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। তুর্কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ইউরোপীয় শক্তির প্রভাব প্রতিহত করার চেষ্টা করে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাগাদ অটোমান উত্তর-রাষ্ট্রগুলোতে প্রতিরোধ ব্যাপক ছিল না।
সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের কঠোর নীতি অটোমান সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনে ঘৃতাহুতি দেয়। তার উৎপীড়নমূলক নীতিতে ইউরোপে শিক্ষালাভকারী শিক্ষিত শ্রেণি অসন্তুষ্ট হয় এবং ইয়াং টার্ক মুভমেন্টের জন্ম হয়। ইয়াং টার্ক মুভমেন্টের মূল লক্ষ্য ছিল ১৮৭৬ সালের সংবিধান পুনরুদ্ধার এবং বৈচিত্র্যময় অটোমান সমাজের সব শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করা। সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ কঠোরভাবে এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেন। মতবিরোধ দেখা দেয়ায় ইয়াং টার্ককে নিষিদ্ধ করা হয় এবং আনোয়ার পাশা দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন শুরু হয়ে গিয়েছিল। কেননা থ্রেসের একটি ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া ইউরোপের অধিকাংশ ভূখ- অটোমান সাম্রাজ্যের হাতছাড়া হয়ে যায়। বলকান যুদ্ধ পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটায়। ১৯১১ সালে প্রথম বলকান যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে অটোমানরা ইউরোপে তাদের বিশাল ভূখ- হারায়। ১৯১৩ সালে সংঘটিত হয় দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ। অটোমান সাম্রাজ্যের ভূখ- ভাগাভাগি নিয়ে প্রথম বলকান যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মিত্রদের মধ্যে বিবাদ বেধে যায়। এ সুযোগে ব্রিটিশরা তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিনিময়ে আরবদের স্বাধীনতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি
সাবেক অটোমান ভূখ- শাসনে ম্যান্ডেট নামে এক ধরনের বিচিত্র ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা হয়। আরবরা ম্যান্ডেট ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত ছিল না। তাদের দৃষ্টিতে এ ব্যবস্থা ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের নামান্তর। জাতিপুঞ্জ ফ্রান্সকে সিরিয়া ও লেবানন এবং ব্রিটেনকে মেসোপটেমিয়া ও জেরুজালেম শাসনের ম্যান্ডেট প্রদান করে। পরবর্তীতে ফিলিস্তিনকে ম্যান্ডেটরি ফিলিস্তিন এবং ট্রান্সজর্দান আমিরাতে বিভক্ত করা হয়। আরব উপদ্বীপে অটোমান সাম্রাজ্যের ভূখ- হেজাজ রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সালতানাত অব নজদ (আজকের সৌদি আরব) এবং ইয়েমেনের মুতাওয়াক্কিল রাজ্য হেজাজ দখল করে নেয়। পারস্য উপসাগরের পশ্চিম উপকূলে অটোমান সাম্রাজ্যের ভূখ-গুলো হয়তো সৌদি আরব একীভূত করে নয়তো ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্য (কুয়েত, বাহরাইন ও কাতার) হিসেবে বহাল থাকে এবং পারস্য উপসাগরে আরব রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
১৯২০ সালে সেভার্স চুক্তি স্বাক্ষরের পর অটোমান সরকারের পুরোপুরি পতন ঘটে। তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধ ইউরোপীয় শক্তিগুলোকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে বাধ্য করে। ইউরোপের বৃহৎ শক্তি এবং তুরস্কের গ্রান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি সেভার্স চুক্তি এড়িয়ে ১৯২৩ সালে লাউসেন চুক্তি স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে এবং অধিকাংশ ভূখ-গত ইস্যু নিষ্পত্তি করে। ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত লাউসেন চুক্তি অনুযায়ী মসুল মেসোপটেমিয়ায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের আওতায় পড়ে। কিন্তু নয়া তুর্কি প্রজাতন্ত্র এ প্রদেশকে তাদের ঐতিহাসিক ভূখ-ের অংশ হিসেবে দাবি করে।
১৯২৬ সালে জাতিপুঞ্জের অধীনে ইরাক ও তুরস্কের মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের সাবেক মসুল প্রদেশ নিয়ে একটি অমীমাংসিত বিরোধ মীমাংসা করে। মুদ্রোস চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার তিনদিন পর ২ নভেম্বর ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্যার উইলিয়াম মার্শাল মসুলে আক্রমণ চালান এবং ১৫ নভেম্বরের মধ্যে তিনি অটোমান সৈন্যদের পরাজিত এবং তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। অবৈধভাবে দখল করায় অটোমানরা মসুলের ওপর ব্রিটিশের অধিকার মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। লাউসেন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও ব্রিটেন অন্যায়ভাবে মসুল শাসন করছিল। বাগদাদ ও লন্ডনের ব্রিটিশ কর্মকর্তারা অব্যাহতভাবে বিশ্বাস করছিলেন যে, ইরাকের অস্তিত্বের জন্য মসুল অপরিহার্য। কেননা এ ভূখ- ছিল সম্পদশালী এবং ইরাকের পার্বত্য সীমান্তের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তুর্কি নেতৃবৃন্দ আশঙ্কা করতেন যে, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে কুর্দি জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হবে এবং তুরস্কে কুর্দিদের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি করবে। মসুল বিরোধের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছতে একটি তথ্যানুসন্ধানী মিশন পাঠানোর জন্য জাতিপুঞ্জের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কমিশন এ অঞ্চলে অনুসন্ধান চালায় এবং রিপোর্ট করে যে, মসুলের ওপর তুরস্কের কোনো অধিকার নেই। এ ভূখ- ব্রিটিশের এবং এখানে কারো বৈধ অধিকার নেই। ব্রিটেনের ব্যাপক প্রভাব থাকায় জাতিপুঞ্জ এ পক্ষপাতদুষ্ট রায় দেয়। ১৯২৬ সালের ৫ জুন ব্রিটেন, তুরস্ক ও ইরাক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তিতে জাতিপুঞ্জের তথ্যানুসন্ধানী মিশনের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা হয়। ১৯৩২ সালে ইরাক স্বাধীনতা লাভ করা নাগাদ মসুল ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অব মেসোপটেমিয়ার অধীনে ছিল। ব্রিটিশ ও ফরাসিরা সাইকস-পিকোট চুক্তি অনুযায়ী বৃহত্তর সিরিয়া নামে পরিচিত মধ্যপ্রাচ্যের পূর্বাংশকে ভাগাভাগি করে। অটোমান সাম্রাজ্যকে ভাগাভাগি করতে ইতালি ও রাশিয়ার সঙ্গে তাদের আরো কয়েকটি চুক্তি হয়। বেলফোর ঘোষণা আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদী আন্দোলনকে ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে। ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অংশীদার রাশিয়া রুশ বিপ্লবের পর অটোমান সাম্রাজ্য ভাগাভাগি থেকে বঞ্চিত হয়। সেভার্স চুক্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে এ অঞ্চলে জাতিপুঞ্জের ম্যান্ডেট, ইয়েমেনের স্বাধীনতা এবং সাইপ্রাসের ওপর ব্রিটিশের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। দীর্ঘদিন থেকে পাশ্চাত্যের দেশগুলো বিশ্বাস করতো যে, পর্যায়ক্রমে একদিন তারা অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন অঞ্চলের ওপর আধিপত্য কায়েম করবে। মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত অবস্থান ভারতীয় উপনিবেশে যাবার পথে হওয়ায় ব্রিটেন এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছিল এবং দেশটি রাশিয়ার সঙ্গে ‘গ্রেট গেইম’ নামে পরিচিত প্রভাব বিস্তারের একটি লড়াইয়ে নিজেকে জড়িত দেখতে পায়। বৃহৎ শক্তিগুলো প্রথম বিশ্ব যুদ্ধোত্তর বিশ্বে তাদের পরস্পরবিরোধী লক্ষ্য নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে এবং কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় ও ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন করে।
সিরিয়ায় ফরাসি দখলদারিত্ব
জাতিপুঞ্জের ম্যান্ডেট হিসেবে সিরিয়া ও লেবানন ফরাসি আশ্রিত ভূখ-ে পরিণত হয়। শিগগির ফরাসি ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়। আরব জাতীয়তাবাদ মোকাবিলায় ফ্রান্স এ ম্যান্ডেটকে লেবানন ও চারটি উপ-রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। ম্যান্ডেট সিস্টেম ছিল উপনিবেশবাদ থেকে আলাদা এবং সাবেক অটোমান ভূখ-ের আইনগত মর্যাদা বা জাতিপুঞ্জের পক্ষ থেকে এসব ভূখ- শাসনের অধিকার। বলা হয়েছিল যে, অধিবাসীরা নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো নাগাদ নিয়ন্ত্রক দেশ একটি ট্রাস্টি হিসেবে কাজ করবে। তখন ম্যান্ডেটের অবসান ঘটবে এবং একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হবে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরবর্তী দুবছর ব্রিটেন অটোমান মেসোপটেমিয়ার (ইরাক) অধিকাংশ এবং অটোমান সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চল (ফিলিস্তিন ও ট্রান্সজর্দান) নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে ফ্রান্স নিয়ন্ত্রণ করে অটোমান সিরিয়ার বাদবাকি অংশ, লেবানন, আলেক্সান্ড্রেটা (হ্যাতে) এবং তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল। ১৯২০-দশকের গোড়ার দিকে জাতিপুঞ্জ এসব ভূখ-ে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯২৩ সালের সালের ২৯ মে ফ্রান্সের কাছে সিরিয়ায় জাতিসংঘের ম্যান্ডেট অর্পণ করা হয়। এ ম্যান্ডেটের মধ্যে মূল সিরিয়া ছাড়া আজকের লেবানন এবং আলেক্সান্ড্রেটাও ছিল। পরবর্তীতে সিরিয়ার বেশ কয়েকটি সরকার ফ্রান্সের অধীনে এ অঞ্চলের শাসন অব্যাহত রাখে। ১৯৩৯ সালে তুরস্ক আলেক্সান্ড্রেটা একীভূত করে। ১৯৪৩ সালে সিরিয়া ও লেবানন পৃথক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা নাগাদ ফ্রান্সের ম্যান্ডেট স্থায়ী হয়। ১৯৪৬ সালে ফরাসি সৈন্যরা সিরিয়া ও লেবানন থেকে বিদায় নেয়।
১৯১৮ সালে সিরিয়ায় অটোমানরা পরাজিত হলে ফয়সালের অধীনস্ত বিদ্রোহী আরব বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে জেনারেল স্যার এডমান্ড এলেনবাইয়ের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা দামেস্কে প্রবেশ করে। ব্রিটিশের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে আরবরা আশা করছিল যে, উত্তরে সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে দক্ষিণে ইয়েমেনের এডেন পর্যন্ত সব আরব ভূখ- নয়া সরকারের শাসনাধীনে থাকবে। কিন্তু ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে সাইকস-পিকোট গোপন চুক্তি অনুযায়ী জেনারেল এলেনবাই আরব প্রশাসনের কাছে কেবলমাত্র সিরিয়ার পূর্বাঞ্চল হস্তান্তর করেন। দক্ষিণাঞ্চল বা ফিলিস্তিন ব্রিটিশের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। ৮ অক্টোবর ফরাসি সৈন্যরা বৈরুতে অবতরণ করে এবং নাকুরার দক্ষিণে লেবাননের উপকূলীয় অঞ্চল দখল করে। ফরাসিরা অবিলম্বে এ অঞ্চলের স্থানীয় আরব সরকারগুলো ভেঙ্গে দেয়। ফ্রান্স সিরিয়াকে তার অধীনে রাখাসহ সাইকস-পিকোট চুক্তির পুরোপরি বাস্তবায়ন দাবি করে। ১৯১৯ সালের ২৬ নভেম্বর ফরাসি সৈন্যদের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে যেতে ব্রিটিশ সৈন্যরা দামেস্ক থেকে পিছু হটে। আমির ফয়সাল ১৯১৮ সালের নভেম্বরে বেশ কয়েকবার ইউরোপ সফর করেন এবং ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে তাদের অবস্থান পরিবর্তনে রাজি করানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন। জেনারেল হেনরি গৌরাদকে সিরিয়া ও সিলিসিয়ার হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগদান করা ছিল সিরিয়ায় ফ্রান্সের হস্তক্ষেপের প্রমাণ। ১৯১৯ সালে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে আমির ফয়সাল নিজেকে আরো দুর্বল অবস্থানে দেখতে পান। এ সম্মেলনে ইউরোপীয় শক্তিগুলো আরবদের দাবি অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯১৯ সালের মে মাসে সিরীয় জাতীয় কংগ্রেস নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একই বছরের জুনে দেশটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জনমত জরিপে আমেরিকার কিং-ক্রেন কমিশন সিরিয়ায় এসে পৌঁছে। কমিশন ৩৬টি বৃহত্তম শহর পরিদর্শন, তিন সহস্রাধিক গ্রামের ২ হাজারের বেশি প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং তিন সহস্রাধিক দরখাস্ত গ্রহণ করে। কমিশনের রিপোর্টে ম্যান্ডেট এবং বেলফোর ঘোষণার বিরুদ্ধে সিরীয়দের আপত্তি এবং ফিলিস্তিনসহ বৃহত্তর সিরিয়া গঠনে তাদের দাবি উল্লেখ করা হয়। আমির ফয়সাল ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্সু এবং ইহুদিবাদী নেতা কায়েম ওয়াইজম্যানের সঙ্গে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অভিবাসন প্রশ্নে আপোস করলে সিরিয়ায় গোলযোগ দেখা দেয়। হাশেমীয় বিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয় এবং মূলত বৃহত্তর খ্রিস্টান প্রধান লেবানন রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্তির ভীতি ছড়িয়ে পড়লে মাউন্ট লেবাননের ভেতর ও বাইরের মুসলিম অধিবাসীরা বিদ্রোহ করে। ফ্রান্স নিজেকে সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের অভিভাবক হিসেবে দাবি করে। ১৯২০ সালের মার্চে দামেস্ক কংগ্রেস ফয়সাল-ক্লিমেন্সু চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ কংগ্রেস সিরিয়ার স্বাভাবিক সীমান্তের ভেতর দেশের স্বাধীনতা এবং ফয়সালকে সব আরব ভূখ-ের বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯১৮ সালের অক্টোবরে ফয়সাল প্রথম দামেস্কে যুদ্ধোত্তর একটি নয়া আরব সরকার গঠন করেন এবং আলী রিদা পাশা আল-রিকাবিকে সামরিক গভর্নর হিসেবে ঘোষণা করেন। এ নয়া সরকার সিরিয়ার বড় বড় শহরগুলোতে স্থানীয় সরকার গঠন এবং প্যান-আরব পতাকা উত্তোলন করে। দামেস্ক কংগ্রেস প্রতিবেশি ইরাকের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইউনিয়ন ঘোষণা করে এবং ইরাকের স্বাধীনতা দাবি করে। ২৫ এপ্রিল সুপ্রিম ইন্টার-এলায়েড কাউন্সিল ফ্রান্সকে সিরিয়া (লেবাননসহ) এবং ব্রিটেনকে ফিলিস্তিন (জর্দানসহ) ও ইরাকের ম্যান্ডেট মঞ্জুর করে। ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে সিরীয়রা তীব্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং ১৯২০ সালের ৭ মে হাশিম আল-আত্তাসির নেতৃত্বে একটি সরকার গঠন করা হয়। নয়া সরকার বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যবাহিনীতে লোক ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয় এবং একটি নয়া সৈন্যবাহিনী গঠন শুরু করে।
এসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফ্রান্স ও মাউন্ট লেবাননের মেরোনাইট খ্রিস্টান ধর্মযাজক বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। মেরোনাইট ধর্মযাজক এসব সিদ্ধান্তকে একটি অভ্যুত্থান হিসেবে নিন্দা করেন। বৈরুতে খ্রিস্টান প্রচার মাধ্যম ফয়সাল সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বৈরিতা প্রকাশ করে। লেবাননের জাতীয়তাবাদীরা এ সংকটকে বা’বদায় খ্রিস্টানদের একটি সম্মেলন আহ্বানে কাজে লাগায়। এ সম্মেলনে ১৯২০ সালের ২২ মার্চ লেবাননের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ১৯২০ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর জেনারেল হেনরি গৌরাদ বৈরুতকে রাজধানী করে বর্তমান ভৌগোলিক সীমান্তের মধ্যে বৃহত্তর লেবানন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ১৯২৬ সালের ২৩ মে তৃতীয় ফরাসি প্রজাতন্ত্রের অনুকরণে প্রথম লেবাননের সংবিধান জারি করা হয়। জেনারেল গৌরাদ ১৯২০ সালের ১৪ জুলাই ফয়সালের প্রতি হুঁশিয়ারি জারি করে বলেন, হয়তো তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে নয়তো সিংহাসন ত্যাগ করতে হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য নিজের অনুকূলে নেই বুঝতে পেরে ফয়সাল জেনারেল গৌরাদকে সহযোগিতাদানের পথ বেছে নেন। কিন্তু তরুণ যুদ্ধমন্ত্রী ইউসূফ আল-আজমেহ সহযোগিতাদানে অস্বীকৃতি জানান। এ সংকট ফ্রাঙ্কো-সিরিয়া যুদ্ধের জন্ম দেয়। আল-আজমেহর নেতৃত্বে সিরীয় সৈন্য, বেদুইন অশ্বারোহী ও বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবক জেনারেল মেরিয়ানো গয়বেটের নেতৃত্বে মায়সালুনে ১২ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফরাসি সৈন্যের মুখোমুখি হয়। একদিন স্থায়ী যুদ্ধে ফরাসিরা বিজয়ী হয় এবং বহু সিরীয় সৈন্যসহ আজমেহ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। অবশিষ্ট সৈন্যরা স্বপক্ষত্যাগ করে। ১৯২০ সালের ২৪ জুলাই জেনারেল গয়বেট প্রায় বিনা বাধায় দামেস্ক দখল করেন এবং দুবছর পর ১৯২২ সালের ২৪ জুলাই লন্ডনে ম্যান্ডেট লিখা হয়।
ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ দখলদারিত্ব
ব্রিটিশকে তিনটি ম্যান্ডেট দেয়া হয়। তার একটি ছিল ফিলিস্তিন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সিরিয়া থেকে ফিলিস্তিনকে পৃথক করা হয় এবং এ ভূখ- ব্রিটিশের শাসনাধীনে ন্যস্ত করা হয়। সাবেক অটোমান সানজাক নাবলুস, আক্রা এবং সিরিয়া ও বৈরুত বেলায়েতের দক্ষিণাঞ্চল এবং জেরুজালেম ছিল ফিলিস্তিনের অংশ। ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন অব্যাহত ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে এ ভূখ- ফিলিস্তিন নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে আরো কয়েকটি নাম ব্যবহার করা হয়। সেগুলো হলো ম্যান্ডেটরি ফিলিস্তিন, ম্যান্ডেট ফিলিস্তিন, দ্য ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অব ফিলিস্তিন ও ব্রিটিশ ফিলিস্তিন। ইউরোপীয়রা তাকে বলতো প্যালেস্টাইন এবং আরবরা বলতো ফিলিস্তিন। অন্যদিকে ইহুদিদের কাছে ‘প্রতিশ্রুত ভূখ-।’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে জেনারেল এলেনবাইয়ের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী সিনাই ও ফিলিস্তিন অভিযানকালে সিরিয়া থেকে তুর্কিদের বিতাড়িত করে। যুক্তরাজ্য শেরিফ হোসেনের সঙ্গে পত্রবিনিময়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, আরবরা অটোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তাদের একটি স্বাধীন আবাসভূমি দেয়া হবে। কিন্তু উভয়পক্ষ এ প্রতিশ্রুতির ভুল ব্যাখ্যা করে এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্স সাইকস-পিকোট চুক্তি অনুযায়ী এ ভূখ- বিভক্ত করে। ফিলিস্তিন ভাগ করার সিদ্ধান্ত ছিল ব্রিটিশের একটি বিশ্বাসঘাতকতা। ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে। বেলফোর ঘোষণায় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের একটি আবাসভূমি গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা অটোমান সিরিয়ায় একটি যৌথ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২০ সালের জুলাইয়ে একজন হাইকমিশনারের নেতৃত্বে একটি সামরিক প্রশাসন বেসামরিক প্রশাসনের স্থলাভিষিক্ত হয়। প্রথম হাইকমিশনার ইহুদিবাদী কেবিনেট মন্ত্রী হার্বার্ট স্যামুয়েল দায়িত্ব গ্রহণে ১৯২০ সালের ২০ জুন ফিলিস্তিনে এসে পৌঁছান। ১৯২২ সালের জুনে ব্রিটিশরা জাতিপুঞ্জের কাছ থেকে তাদের অব্যাহত নিয়ন্ত্রণের স্বপক্ষে বৈধতা লাভ করে। ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে জাতিপুঞ্জের সম্মতিতে বেসামরিক ম্যান্ডেট প্রশাসনকে আনুষ্ঠানিকতা দেয়া হয়। জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের ভূখ- ফিলিস্তিন ১৯৪৮ সাল নাগাদ সরাসরি ব্রিটিশ শাসনাধীনে ছিল। অন্যদিকে ট্রান্সজর্দান নামে জর্দান নদীর পূর্বদিকে আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটি ছিল হেজাজ থেকে আগত হাশেমীয় বংশের শাসনাধীনে। ১৯৪৬ সালে ট্রান্সজর্দান স্বাধীনতা লাভ করে।
মেসোপটেমিয়ায় ব্রিটিশ দখলদারিত্ব
সাইকস-পিকোট চুক্তি অনুযায়ী মেসোপটেমিয়া ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের আওতায় ন্যস্ত হয়। ১৯২০ সালের ২৫ এপ্রিল ইতালির স্যান রেমিও সম্মেলনে এ ভূখ- ব্রিটেনের ম্যান্ডেটের অধীনে ন্যস্ত করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। কিন্তু এ সম্মেলনে ম্যান্ডেটের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। জাতিপুঞ্জ সনদের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদের আওতায় মেসোপটেমিয়াকে ‘এ শ্রেণির’ ম্যান্ডেট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯২০ সালের জুনে ব্রিটিশ কলোনিয়াল অফিস একটি খসড়া ম্যান্ডেট দলিল প্রস্তুত করে। অ্যাংলো-ইরাক চুক্তিতে ম্যান্ডেট চূড়ান্ত করা হয়। প্রস্তাবিত ম্যান্ডেট কয়েকটি প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়। ১৯২০ সালে দেশব্যাপী বিদ্রোহ দেখা দিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এ ভূখ- ইরাক রাজ্যে পরিণত হবে। জাতিপুঞ্জের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী ১৯৩২ সালে ইরাক রাজ্য স্বাধীনতা লাভ করে। জাতিপুঞ্জ সনদে বলা হয়, এ ধরনের রাষ্ট্রকে পুরোপুরি স্বাধীন রাষ্ট্রে উত্তরণে সহায়তা করা হবে। স্বাধীনতা দেয়া হলেও ব্রিটেন ইরাকে কয়েকটি ঘাঁটি বজায় রাখে এবং ব্রিটিশ সৈন্যদের ট্রানজিট অধিকার নিশ্চিত করে। হাইকমিশনার স্যার পার্সি কক্স যুদ্ধোত্তর ইরাকি সরকারের নেতৃত্ব দেন। নাজাফে একজন ব্রিটিশ অফিসারের হত্যাকা-ের প্রতিশোধ গ্রহণ করা হলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ প্রশাসন তখনো উত্তর ইরাকের পার্বত্যাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ব্রিটিশ প্রশাসনকে জাতীয়তাবাদীদের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ মোকাবিলা করতে হয়। জাতীয়তাবাদীরা দেখতে পায় যে, ম্যান্ডেট মর্যাদা দিয়ে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। শেরিফ হোসেনের তৃতীয় পুত্র ফয়সাল বিন হোসেন বিন আল-হাশেমী ১৯২০ সালে বৃহত্তর সিরিয়া এবং ১৯২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ইরাকের বাদশাহ হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ফয়সাল অভিন্ন আনুগত্য লাভ এবং একটি আরব রাষ্ট্র গঠনে সুন্নি ও শিয়া মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। ১৯১৩ সালে তিনি অটোমান পার্লামেন্টে জেদ্দা শহরের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ১৯১৬ সালে কন্সটান্টিনোপলের একটি মিশনে তিনি দুবার দামেস্ক সফর করেন। ১৯১৬ সালের ২৩ অক্টোবর ওয়াদি সাফ্রার হামরায় তিনি ব্রিটিশ গুপ্তচর ক্যাপ্টেন টিই লরেন্সের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৯২১ সালের মার্চে কায়রো সম্মেলনে ব্রিটিশরা ইরাকের রাজনৈতিক মানদ- নির্ধারণ করে। তারা ইরাকের বাদশাহ হিসেবে হাশেমীয় ফয়সালকে বেছে নেয়। তারা একটি ইরাকি সৈন্যবাহিনী গঠন করে। তবে এসিরীয়দের সরাসরি ব্রিটিশ কমান্ডে রেখে দেয়া হয়। বাদশাহ হিসেবে ফয়সালের নিয়োগ অনুমোদনে একটি গণভোটের আয়োজন করা হয়। ৯৬ শতাংশ ভোট তার অনুকূলে পড়ে। জাতীয়তাবাদী এবং নাজাফ ও কারবালার মুজতাহিদরা ব্রিটিশের প্রভাব হ্রাসে ফয়সালের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। ১৯২০ সালে ইরাকি বিদ্রোহের পর ১৯২১ সালে প্রস্তাবিত মেসোপটেমিয়ায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের পরিবর্তে ম্যান্ডেটরি ইরাক গঠন করা হয়। একই বছরের জুলাইয়ে ফরাসিরা ফয়সাল বিন হোসেনকে বিতাড়িত করে। তারপর ব্রিটিশরা তাকে একটি রাজ্য হিসেবে শাসন করার জন্য ইরাকি ভূখ- মঞ্জুর করে। তবে ব্রিটিশ বিমান বাহিনী কয়েকটি সামরিক ঘাঁটিতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। কারবালার গ্রান্ড মুজতাহিদ ইমাম শিরাজি ও তার পুত্র মির্জা মোহাম্মদ রেজা বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ইমাম শিরাজি একটি ফতোয়া জারি করে বলেন, মুসলমানদের ওপর অমুসলিমদের শাসন অবৈধ। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জেহাদের ডাক দেন।
ইরাকে বিদ্রোহ
১৯২০ সাল নাগাদ মসুলে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং বিদ্রোহ দক্ষিণে ফোরাতের ভাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণের স্বায়ত্তশাসিত গোত্রগুলো বিদ্রোহে যোগদানে সামান্য আগ্রহ দেখায়। তারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিদ্রোহে সহযোগিতা করেনি। এতে বিদ্রোহের তীব্রতা মন্থর হয়ে যায়। দেশটিতে তিন মাস নৈরাজ্য বিরাজ করে। ভারত থেকে শক্তিবৃদ্ধি করা হলে ব্রিটিশরা শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। ১৯২০ সালের গ্রীষ্মকালে বাগদাদে বিদ্রোহ শুরু হয়। সাবেক অটোমান সৈন্যবাহিনীর অসন্তুষ্ট অফিসারসহ বেসামরিক লোক বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। শিয়া অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে বিদ্রোহ গতিলাভ করে। শিয়া শেখ মেহেদী আল-খালিসি ছিলেন বিদ্রোহের নেতা। বিদ্রোহকালে সুন্নি ও শিয়া সম্প্রদায় একে অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা করে। তাদের পাশাপাশি উপজাতীয় গোত্র, শহরের বাসিন্দা এবং বহু ইরাকি অফিসার এগিয়ে আসে। ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ এবং একটি স্বাধীন আরব সরকার গঠন করা ছিল বিদ্রোহের লক্ষ্য। ১৯২০ সালে অক্টোবরের শেষ নাগাদ কিছুটা সাফল্য অর্জন করলেও ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হয়। ১৯২০ সালের শেষ নাগাদ বিদ্রোহ থেমে যায়। ১৯২০ সালের বিদ্রোহকালে উত্তর ইরাকে কুর্দিরা আরেকটি ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ করে। কুর্দিরা স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা করছিল। শেখ মাহমুদ বারজানি ছিলেন কুর্দি বিদ্রোহের অন্যতম নেতা।
ব্রিটিশরা সাবেক অটোমান কর্তকর্তাদের চাকরিচ্যুত করে নয়া প্রশাসনে ব্রিটিশ অফিসারদের নিয়োগ দেয়। সাবেক অটোমান প্রদেশগুলো ম্যান্ডেট কনসেপ্টকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ঔপনিবেশবাদী ইউরোপীয় শক্তিগুলো ভিন্ন নামে তাদের শাসন করতে চায়। ইরাকের অধিকাংশ লোক আশঙ্কা করছিল যে, তাদের দেশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ঠিক তখন ইরাকের বিখ্যাত শিয়া মুজতাহিদ আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ ত্বকি আল-শিরাজি একটি ফতোয়া জারি করেন। ফতোয়ায় তিনি ব্রিটিশের অধীনে চাকরিকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করেন। ব্রিটিশের নয়া রাজস্ব নীতিতে ইরাকিরা ক্ষুদ্ধ হয়। ইরাকের পবিত্র নাজাফ শহরে হাজার হাজার লোক সমাহিত হতে চাইতেন। ব্রিটিশরা আইন করে যে, নাজাফে সমাহিত হতে হলে রাজস্ব পরিশোধ করতে হবে। শিয়া আলেম ও উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেন। তবে তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ব্যর্থ হলে সহিংস বিদ্রোহের আশ্রয় নিতে হবে।
১৯২০ সালের মে মাসে বাগদাদে গণসমাবেশ ও বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহ শুরু হয়। সুন্নি ও শিয়া মসজিদগুলোতে বিশাল বিশাল জমায়েত হতে থাকে। এসব সমাবেশ ইরাকের দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতার প্রমাণ বহন করছিল। এমনি একটি সমাবেশে ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে ইরাকের স্বাধীনতার দাবি উত্থাপনে ১৫-সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বাছাই করা হয়। ভারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সিভিল কমিশনার আর্নল্ড উইলসন অবাস্তব হিসেবে তাদের দাবি নাকচ করে দেন। ১৯২০ সালের জুনে সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। আয়াতুল্লাহ আল-শিরাজি আরেকটি ফতোয়া জারি করে বলেন, স্বাধীনতা ইরাকিদের অধিকার। স্বাধীনতার দাবি আদায়ে তাদেরকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। তবে ব্রিটিশরা তাদের অধিকার আদায়ে বাধা দিলে আত্মরক্ষায় শক্তিপ্রয়োগ অনুমোদনযোগ্য। তার এ ফতোয়া ছিল সশস্ত্র বিদ্রোহে উৎসাহদান। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সশস্ত্র বিদ্রোহ এড়িয়ে যাবার আশা করছিল এবং তারা জাওয়ালিম গোত্রের শেখকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে একদল অনুগত সশস্ত্র উপজাতীয় যোদ্ধা কারাগার আক্রমণ করে এবং তাকে মুক্ত করে। মধ্য ফোরাত অঞ্চলে ব্রিটিশ ঘাঁটি দুর্বল হওয়ায় বিদ্রোহ দানা বেধে ওঠে।
জুলাইয়ের শেষ নাগাদ সশস্ত্র উপজাতীয় বিদ্রোহীরা মধ্য ফোরাত অঞ্চলের অধিকাংশ জায়গার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। উপজাতীয় বিদ্রোহীরা সফল হলে বিদ্রোহ ফোরাতের নি¤œাঞ্চল এবং বাগদাদের আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল অবিলম্বে রাজকীয় বিমান বাহিনীর দুটি স্কোয়াড্রনসহ ইরান থেকে শক্তিবৃদ্ধি অনুমোদন করেন। বিমান বাহিনী ব্যবহার করায় ব্রিটিশের অনুকূলে পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায়। ব্রিটিশ বিমান বাহিনী বিদ্রোহ দমনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। কয়েকটি ইরাকি গোত্র বিদ্রোহের বিরুদ্ধে কাজ করে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং স্বীকৃতির বিনিময়ে তারা লাভবান হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে বিদ্রোহীদের রসদ ও তহবিল ঘাটতি দেখা দেয়। এতে তারা বেশি দিন বিদ্রোহ চালিয়ে যেতে অক্ষম হয়ে পড়ে। ১৯২০ সালের অক্টোবরে বিদ্রোহীরা নাজাফ ও কারবালায় ব্রিটিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলে বিদ্রোহের অবসান ঘটে।
বিদ্রোহে ৬ থেকে ১০ হাজার ইরাকি এবং পাঁচ শো ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়। ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর বিমানগুলো আকাশে মোট চার হাজার ৮ ঘণ্টা উড্ডয়ন, ৯৭ টন বোমা নিক্ষেপ এবং এক লাখ ৮৩ হাজার ৮৬১ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ১১টি ব্রিটিশ বিমান ধ্বংস হয়। এ বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ায় ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে তাদের ইরাক নীতি পর্যালোচনা করতে হয়। উইন্সটন চার্চিল ইরাকে একটি নয়া সরকার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশে তিনি কায়রোতে একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। ১৯২১ সালের মার্চে কায়রো সম্মেলনে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা ইরাকের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেন। ব্রিটিশরা তাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন আরবদের ক্ষমতায় বসানোর আগ্রহ প্রকাশ করে। অবশেষে তারা ফয়সাল বিন হোসেনকে ইরাকের বাদশাহ হিসেবে সিংহাসনে বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

অটোমান সাম্রাজ্যের পতন
লেখক : সাহাদত হোসেন খান
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬২৪
মুদ্রিত মূল্য: ৭৫০ টাকা

#আফসার_ব্রাদার্স
#পৃথিবীর_সবচেয়ে_ভালো_বন্ধুর_নাম_বই

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Chat with Afsar Brothers