ফারাও তুতেনখামেনের রহস্যময় অভিশাপ
তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কার করার পর থেকে হাওয়ার্ড কার্টারের টিমের কয়েকজন সদস্য এবং সমাধি পরিদর্শনকারী কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করায় বহু লোক বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, ফারাও তুতেনখামেনের অভিশাপে তাদের মৃত্যু হয়েছে। ১৯২২ সালে কার্টারের টিম তুতেনখামেনের কবর
(কেভি-৬২) উন্মুক্ত করে এবং তার মধ্য দিয়ে আধুনিক মিসরবিদ্যার যুগের সূচনা হয়। বিখ্যাত মিসর বিশেষজ্ঞ জেমস হেনরি ব্রিস্টেড প্রথম কবর উন্মোচনের পর পর কার্টারের সঙ্গে কাজে যোগ দেন। কার্টার তার বাসায় কিভাবে একজন বার্তাবাহক পাঠিয়েছিলেন তিনি তা স্মরণ করেন। বার্তাবাহক জেমস হেনরি ব্রিস্টেডের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলে মানুষের মতো একটি আর্তচিৎকার শুনতে পান। বাড়ির প্রবেশদ্বারে পৌঁছে বার্তাবাহক একটি পাখির খাঁচায় মিসরীয় রাজবংশের প্রতীক গোখরো সাপ দেখতে পান। খাঁচার মুখে পাখির মৃত্যু হলে তুতেনখামেনের অভিশাপের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মিসর সরকারের পুরাকীর্তি বিষয়ক পূর্ববর্তী ইন্সপেক্টর জেনারেল আর্থার উইগাল বলেন,
যেদিন তুতেনখামেনের কবর উলেখক : সাহাদত হোসেন খানন্মুক্ত করা হয় ঠিক সেদিন কার্টারের বাড়িতে রাজকীয় গোখরো অনুপ্রবেশ করে। প্রাচীন মিসরের রাজারা শত্রুকে আঘাত করার জন্য তাদের মাথায় গোখরো সাপ বহন করতেন। ১৯২২ সালের ২২ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসে এ ঘটনার বর্ণনা ছাপা হয়। প্রথমেই লর্ড কারনারভন রহস্যসজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে একটি মশা দংশন করেছিল এবং পরবর্তীতে শেভ করার সময় তিনি দুর্ঘটনাক্রমে দংশিত জায়গাটি কেটে ফেলেন। এতে ইনফেকশন হয়ে পচন ধরে। দুই সপ্তাহ আগে ইংরেজ ঔপন্যাসিক মেরি কোরেলি একটি কাল্পনিক চিঠি লিখেছিলেন। নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনে এ চিঠি প্রকাশিত হয়। চিঠিতে তিনি অজ্ঞাতনামা একটি বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখেছিলেন, রুদ্ধ কোনো সমাধিতে অনুপ্রবেশ করা হলে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। তার ভাষ্য নিয়ে প্রচার মাধ্যমে তোলপাড় পড়ে যায়। প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, তুতেনখামেনের সমাধিতে একটি সাপ খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে এ সংবাদ ছিল অসত্য। কুসংস্কারাচ্ছন্ন বেনিতো মুসোলিনী একসময় উপঢৌকন হিসেবে মিসরীয় মমি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি পালাজ্জো সিগি (প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন) থেকে মমি অপসারণের নির্দেশ দেন। রহস্য উপন্যাস শার্লক হোমসের লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল বলেছেন, তুতেনখামেনের অনুগত পুরোহিতদের তৈরি অতি প্রাকৃত প্রাণীরা লর্ড কারনারভনকে হত্যা করে। রাজকীয় সমাধি রক্ষায় এসব অতি প্রাকৃত প্রাণী সৃষ্টি করা হয়েছিল। এতে প্রচার মাধ্যমের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। আর্থার ওয়েগাল উল্লেখ করেন যে, তুতেনখামেনের সমাধি উন্মুক্ত করার সময় তিনি তাকে অট্টহাসি দিতে এবং রসিকতা করতে দেখতে পান। নিকটবর্তী ব্রিটিশ সাংবাদিক এইচভি মোর্টনকে রাজা বলেছিলেন, ‘আমি তাকে (কারনারভন) বাঁচার জন্য ৬ সপ্তাহ সময় দিলাম।’ ডা. ডেরি তুতেনখামেনের মমির প্রথম ময়না তদন্তকালে তার বাম গালে একটি নিরাময় ক্ষত দেখতে পান। ৬ মাস আগে কারনারভনকে সমাহিত করায় রাজার এ ক্ষতস্থানের সঙ্গে কারনারভনের দংশিত স্থানের কোনো সাদৃশ্য আছে কিনা তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। মেডিকেল জার্নাল দ্য লাঞ্চেট পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়, তুতেনখামেনের সমাধির সঙ্গে লর্ড কারনারভনের মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। বিষাক্ত ছত্রাকে তার মৃত্যুর তত্ত্বও বাতিল করে দেয়া হয়। রিপোর্টে আরো বলা হয়, বেশ কয়েকবার লর্ড কারনারভনসহ অনেকে তুতেনখামেনের সমাধিতে প্রবেশ করেন। কিন্তু অন্য কেউ সংক্রমিত হননি। লর্ড কারনারভনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে নিউমোনিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। বিভিন্ন জটিলতার মধ্যে নিউমোনিয়া ছিল অন্যতম কারণ। ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ থেকে বহুরোগের উৎপত্তি হয়। লর্ড কারনারভন ঘন ঘন ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হতেন। একবার ব্রঙ্কাইটিসে তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় তার মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
১৯২৫ সালে নৃবিজ্ঞানী হেনরি ফিল্ড মিসর বিশেষজ্ঞ জেমস হেনরি ব্রিস্টেডের সঙ্গে তুতেনখামেনের সমাধি পরিদর্শন করেন এবং ব্রিটিশ প্রত্মতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টারের দয়া ও বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করেন। হাওয়ার্ড কার্টারের বন্ধু স্যার ব্রুস ইনগ্রামকে দেয়া একটি পেপারওয়েট কিভাবে ব্রেসলেট সজ্জ্বিত মমিযুক্ত হাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল তিনি তার বর্ণনা দেন। ব্রেসলেটে লেখা ছিল: ‘যে আমার দেহ স্থানান্তর করবে তার জন্য অভিসম্পাত। তার কাছে আগুন, বন্যা ও মহামারী আসবে।’ উপঢৌকন গ্রহণের কয়েকদিন পর স্যার ব্রুস ইনগ্রামের বাড়ি ভস্মীভূত হয়। পুনঃনির্মাণকালে বন্যা দেখা দেয়। হাওয়ার্ড কার্টার এ ধরনের অভিশাপ সম্পর্কে পুরোপুরি সন্দিহান ছিলেন। ১৯৬২ সালের মে মাসে তিনি ডায়েরিতে একটি অদ্ভূত বিবরণী লিপিবদ্ধ করেন। মৃত্যু দেবতা আনুবিস যে ধরনের শিয়াল দেখতেন, মরুভূমিতে ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করার পর তিনি একই ধরনের শিয়াল দেখেন। সংশয়বাদীরা উল্লেখ করেছেন যে, অন্য যারা তুতেনখামেনের সমাধি পরিদর্শন করেছেন অথবা আবিষ্কারে সহায়তা করেছেন তারা দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন এবং সুস্থ ছিলেন। একটি জরিপে দেখা যায়, তুতেনখামেনের সমাধি ও তার মমি উন্মুক্ত করার সময় ৫৮জন উপস্থিত ছিলেন। ১২ বছরের মধ্যে মাত্র ৮ জন মৃত্যুবরণ করেন। হাওয়ার্ড কার্টারসহ অন্যরা জীবিত ছিলেন। ১৯৩৯ সালে ৬৪ বছর বয়সে কার্টার লিম্ফোমায় আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। শেষ জীবিত ব্যক্তি হলেন লর্ড কারনারভনের কন্যা লেডি এভিলিন হার্বার্ট। লেডি হার্বার্ট হলেন তুতেনখামেনের সমাধিতে প্রথম প্রবেশকারীদের অন্যতম। তিনি আরো ৫৭ বছর জীবিত ছিলেন এবং ১৯৮০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। আমেরিকান প্রত্মতত্ত্ববিদ জেও কিনামেন আরো ৩৯ বছর জীবিত ছিলেন। তিনি ১৯৬১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
তুতেনখামেনের অভিশাপে মৃত্যুবরণকারীরা হলেন:
খননকাজে অর্থ যোগানদাতা কারনারভনের পঞ্চম আর্ল জর্জ হার্বার্ট তুতেনখামেনের সমাধি উন্মুক্ত করার সময় উপস্থিত ছিলেন। এ ঘটনার ৪ মাস ৭ দিন পর ১৯২৩ সালের ৫ এপ্রিল তিনি মশার দংশনে মৃত্যুবরণ করেন।
তুতেনখামেনের সমাধি পরিদর্শনকারী জর্জ গে প্রথম গাউল্ড জ¦রে আক্রান্ত হয়ে ১৯২৩ সালের ১৬ মে ফরাসি অবকাশ যাপন কেন্দ্রে মৃত্যুবরণ করেন।
হাওয়ার্ড কার্টারের টিমের সদস্য আর্থার ক্রুটেনডেন্ট মাসি আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় ১৯২৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
কার্টারের সেক্রেটারি অবৈতনিক ক্যাপ্টেন রিচার্র্ড বেথেল ১৯২৯ মসালের ১৫ নভেম্বর মেফিয়ার ক্লাবে বিছানায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সন্দেহজনক হত্যাকা-ের শিকার হন।
১৯২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হাওয়ার্ড কার্টার তুতেনখামেনের সমাধি উন্মুক্ত করেন। ১৯৩৯ সালের ২ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কেউ তার মৃত্যুর জন্য তুতেনখামেনের অভিশাপকে দায়ী করেছেন।
প্রাচীন মিশর
লেখক : সাহাদত হোসেন খান
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬২৪
মুদ্রিত মূল্য: ৭০০ টাকা
#আফসার_ব্রাদার্স
#পৃথিবীর_সবচেয়ে_ভালো_বন্ধুর_নাম_বই
Leave a Reply