টেন্ডার ইজ দ্য ফ্লেশ : বিভীষিকাময় ধূসর ভবিষ্যতের গল্প

টেন্ডার ইজ দ্য ফ্লেশ : বিভীষিকাময় ধূসর ভবিষ্যতের গল্প


আর্জেন্টাইন লেখিকা আগুস্তিনা বাস্তারিকা তার টেন্ডার ইজ দ্য ফ্লেশ (মূল স্প্যানিশ শিরোনাম : Cadáver Exquisito উপন্যাসে এক বিভীষিকাময় ধূসর ভবিষ্যতের গল্প বলেছেন। ২০১৭ সালে স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত ডিস্টোপিয়ান, স্প্ল্যাটারপাঙ্ক হরর উপন্যাসটি ‬ দ্রুতই আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে এবং ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে সাহিত্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
আধুনিক সমাজের অসঙ্গতি, নৈতিকতার প্রশ্ন এবং মানব প্রকৃতির অন্ধকার দিক নিয়ে রচিত এই চাঞ্চল্যকর উপন্যাস পাঠককে প্রচন্ড অস্বস্তিতে ভোগায়। উপন্যাসটির পটভূমি এমন এক ডিস্টোপিয়ান বিশ্বে, যেখানে অজানা ভাইরাসের সংক্রমণে প্রাণীজ মাংস খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এর ফলে মানবজাতি বিকল্প খাদ্য উৎস খুঁজতে বাধ্য হয় এবং মানুষকে “স্পেশাল মিট” হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করে ভক্ষণ শুরু করে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মারকোস তেজো একটি মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার ম্যানেজার, যেখানে মানুষকেই মাংস হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে সে ভিতরে যন্ত্রণা জর্জরিত। সমাজের নিষ্ঠুর নিয়ম অনুযায়ী, এই কাজ তার কাছে স্বাভাবিক হলেও, পাঠক তার কাজের বিবরণে অস্বস্তি অনুভব করে। মারকোস পেশাগত ‬দিক থেকে ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের এবং বাস্তববাদী। তবে এই নিষ্ঠুরতার পিছনে তার নিজস্ব ইচ্ছার চেয়ে সমাজের চাপ বেশি কার্যকর। এই নিষ্ঠুর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। তার নৈতিক দ্বন্দ্বের সত্ত্বেও, প্রথার সাথে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়। মারকোসের চরিত্রে মানবিকতার ছাপ স্পষ্ট, বিশেষত তার ব্যক্তিগত জীবনে। সন্তান হারানোর শোক এবং স্ত্রীর সাথে দূরত্ব তাকে ভিতর থেকে নিঃসঙ্গ, একাকী করে তুলেছে। এই ব্যথা এবং একাকীত্ব তাকে জীবনের অর্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে। মারকোস তার বাবার প্রতি এক ধরনের দ্বিধা-বিদ্বেষ অনুভব করে। বাবার অসুস্থতা ও তার দেখাশোনার দায়িত্ব তাকে একদিকে পরিবার-প্রেমী চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করে, আবার অন্যদিকে বাবার পুরোনো মূল্যবোধের প্রতি ক্ষোভের কারণে সে একটি জটিল চরিত্রে পরিণত হয়। এই উপন্যাসটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, কীভাবে পরিস্থিতি অনুযায়ী মানুষের নৈতিকতা পরিবর্তিত হয়। আধুনিক সমাজে প্রাণী এবং প্রক
তির প্রতি যে ব্যবহার করা হয়, তা এখানে মানুষের প্রতি প্রতিফলিত
হয়েছে। বইয়ের মূল চরিত্র মারকোসের পরিবার এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন উপন্যাসটিকে আরও গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। তাই, টেন্ডার ইজ ‬দ্য ফ্লেশ নিছক কোনো গল্প নয় বরং এমন এক আয়না, যা আমাদের ভোগবাদী সমাজের বিকৃত প্রতিচ্ছবি দেখায়। মূলত একটি ডিস্টোপিয়ান কাহিনি হলেও উপন্যাসের প্রতিটি স্তরে রূপকের ব্যবহার অত্যন্ত গভীর এবং জটিল। মানুষের মাংসকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি মানুষের পণ্যায়ন ও বস্তুবা‬দের একটি শক্তিশালী রূপক। বর্তমান ভোগবাদী সমাজে প্রতিনিয়ত মানুষকেও পণ্যের মতো ব্যবহার করা হয়। চাকরি, শ্রম, এবং সম্পর্কের মাধ্যমে। এই উপন্যাসে মানুষের মাংস প্রক্রিয়াকরণের দৃশ্য ভোগবাদী অর্থনীতির অতল সীমাকে তুলে ধরে, যেখানে মানবিকতার কোনো স্থান নেই। উপন্যাসে প্রাণীর মাংস খাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মানুষই প্রধান খাদ্যে পরিণত হয়। এটি প্রজাতিক কেন্দ্রিকতা বা “speciesism”-এর সরাসরি সমালোচনা। বাস্তব জীবনে মানুষ যেভাবে প্রাণীজ মাংস ভোগ করে, এই রূপক সেই ব্যবস্থার চরম রূপ তুলে ধরে আমাদের চোখের সামনে। এই উপন্যাসের ডিসটোপিয়ান পৃথিবী একটি শোষণমূলক সমাজের প্রতীক। যারা ক্ষমতাশালী, তারা দূর্বলকে শোষণ করে ‘সেটা যেমন ইতিহাসে প্রমাণিত, তেমনি আধুনিক সমাজেও বিদ্যমান। এখানে ক্ষমতাবান শ্রেণি ‘মাংসদ্ধ উৎপা‬ন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে দুর্বল শ্রেণিকে তাদের চাহিদা পূরণের জন্য ব্যবহার করা হয়। গরিব এবং নিপীড়িতরা সমাজের চাহিদার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করে দেয়। উপন্যাসটি দেখায় যে একটি সমাজে নৈতিকতার চরম পতন কীভাবে মানবিকতার ধ্বংস ঘটায়। মানুষের মধ্যে যখন সহানুভূতি, সংবে‬দনশীলতা এবং মূল্যবোধ হারিয়ে যায়, তখন তারা অন্য মানুষকেও পণ্য হিসেবে দেখার ক্ষমতা অর্জন করে। মানবজাতির অবক্ষয় এবং যান্ত্রিকতাকে ইঙ্গিত করে এই রূপক।

উপন্যাসে নিষিদ্ধ কিছু শব্দ এবং ধারণার কথা বলা হয়েছে। চাইলেই যেমন খাওয়ার জন্য পোষা মানুষকে মানুষ নামে ডাকা যাবে না কিংবা ক্যানিবালিজম শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না। রূপক ভাষার অপব্যবহার এবং মতাবান‬দের দ্বারা সমাজে বাস্তবতাকে পরিবর্তন করার একটি ইঙ্গিত দেয়। শুধুমাত্র নাম বলে জোর করে নিষিদ্ধ জিনিসকে বৈধ করে ফেলার এমন
বাস্তব উদাহরণ আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে। বাস্তারিকার লেখার ধরন অত্যন্ত তীব্র এবং প্রখর। উপন্যাসের ভাষা সহজ-সংক্ষিপ্ত, তবে এর প্রতিটি বাক্য গভীর অর্থবহ। গল্প বলার ধরন
প্রায়শই বর্ণনামূলক, যা এই অমানবিক পৃথিবীর রুক্ষতাকে চিত্রিত করে।
বাস্তারিকা অত্যন্ত শৈল্পিক ও মনস্তাত্ত্বিক গভীরতায় উপন্যাসটিকে নির্মাণ করেছেন, যেখানে প্রতিটি অধ্যায় আমাদের সমাজের বাস্তব পরিস্থিতির সাথে ভীষণ প্রাসঙ্গিক। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, মানুষের প্রকৃত মূল্য কোথায়? সভ্যতা কীভাবে নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করতে পারে? থার্ড পার্সন ন্যারেটিভে
বর্ণিত প্রধান চরিত্র মারকোস তেজোর নাম শুধুমাত্র কথোপকথনের সময় ব্যবহৃত হলেও, পুরো বইয়ে বর্ণনার সময় লেখিকা একবারও সেই নামটি ব্যবহার করেননি। বই পড়ার সময় এই ব্যাপারটা পাঠকের মনে বেশ খানিকটা অস্বস্তির সৃষ্টি করে। ডিস্টোপিয়ান জগতে মানবপশুর বর্ণনায় ‘মানুষ’ সম্বোধনের বিকল্প হিসেবে মাথা, পণ্য, খা‬দ্য, চালান, মাংস জাতীয় শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ মাংসের উৎসকে মানুষ বলে ডাকা যাবে না, কেননা সেক্ষেত্রে তাদেরকে একটা আলা‬দা পরিচয় দিতে হবে।”

এই ধরনের শাব্দিক প্রয়োগের কারণেও পাঠক কিছু ক্ষেত্রে খটকার সম্মুখীন হতে পারেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এই উপন্যাসটি কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। একই সাথে ‬দুর্বল চিত্তের অধিকারী‬দের জন্য নয়। বিষয়বস্তুর কারণেই বইটি অত্যন্ত গ্রাফিক, গোর, ভায়োলেন্ট; যা অধিকাংশ পাঠকের কাছে
অস্বস্তিকর হতে পারে। বইয়ের পাতায় পশু নির্যাতনের ভয়ঙ্কর বর্ণনা, হত্যা, জবাই, ক্যানিবালিজম, ধর্ষণ, যেদ্বনতা, রক্তারক্তি, শিশুমৃত্যু, আত্মহত্যা থেকে শুরু করে অসংখ্য স্পর্শকাতর বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে, যা ‬দুঃস্বপ্নের উ‬দ্রেক ঘটাতে পারে প্রশ্নাতীতভাবে। স্বীকার করতে দোষ নেই, বইটা পড়তে গিয়ে পাঠক হিসেবে যতবার শিউরে উঠেছিলাম, অনুবা‬দের সময় তার দ্বিগুণ অস্বস্তি বোধ করেছি। স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি, তারপর ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবা‬দ করতে গিয়ে মূল বইয়ের টোন ঠিক রাখাটা যথেষ্ট চ্যালেঞ্ছিং ছিল। স্প্যানিশ শব্দের উচ্চারণ থেকে শুরু করে পারিভাষিক শব্দ ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে। উ‬দাহরণস্বরূপ একটা বিষয়ের উল্লেখ করছিঃ মূল বইয়ে মানবপশুর লিঙ্গ বোঝাতে “The Female” অথবা ‟ The Male” লেখা হয়েছিল। বাংলা অনুবাদে সেক্‘মা‬দী’ অথবা ‘মদ্দা’ ব্যবহার করেছি। ব্র্যাকেটের সাহায্যে টীকার মাধ্যমে ব্যাখ্যা ‬দেয়া হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের। সর্বোপরি, ভিন্নধারার এই উপন্যাস অনুবাদে অনুবা‬দক কতটুকু সফল, সেই সিদ্ধান্ত পাঠকের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।

Tender is the Flesh” এমন একটি সাহিত্যকর্ম যা আপনার মনকে নাড়া ‬দেবে, ভাবনায় আচ্ছন্ন করবে। উপলব্ধি করাবে যে, মানবিকতা এবং নৈতিকতা হারিয়ে ফেললে আমাদের ভবিষ্যৎ এই ডিস্টোপিয়ান বিশ্বের মতোই নিষ্ঠুর হতে পারে। সভ্যতার অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকগুলোকে উপলব্ধি করাবে গভীরভাবে।

ধূসর পৃথিবীর এক অস্বস্তিকর যাত্রায় আপনাকে স্বাগতম।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Chat with Afsar Brothers